মা দিবসে মায়ের সঙ্গে দারুণ একটি ছবি ফেসবুকে দিলেন সাজিদ হাসান। বিজ্ঞাপন নির্মাতা একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাজিদ ফেসবুকে লেখালেখির সুবাদে হাজার দশেক অনুসারী নিয়ে বেশ জনপ্রিয়। মায়ের ছবি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অজস্র মন্তব্য আর ফেসবুকের ইমোশন আইকন পেতে থাকেন তিনি। হুট করেই এক ব্যবহারকারী তাঁর পোস্টে রাগী চিহ্ন (ইমোটিকন) দিয়ে বসলেন। সাজিদ বললেন, আমি আসলে কোনো কারণই খুঁজে পাইনি। কেন আমার মায়ের ছবি দেখে কেউ রাগ প্রকাশের ইমোটিকন ব্যবহার করবেন?
পছন্দ, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞ, হাহা, ওয়াও, দুঃখ আর রাগ—এই সাতটি ইমোটিকন দিয়েই ফেসবুকে যেকোনো লেখা বা ছবিতে আবেগ প্রকাশ করা যায়। কৃতজ্ঞতার (গ্রেটফুল) চিহ্নটি কদিন আগে চালু হয়েছে।
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ইমোটিকন হচ্ছে অনলাইনে সংখ্যা আর বিরামচিহ্নের মাধ্যমে মুখচ্ছবিতে আবেগ প্রকাশের একটা ধারা। এখন ইমোটিকনের মতোই আছে ইমোজি। প্রযুক্তিবিষয়ক ম্যাগাজিন দ্য ভার্জ–এর নিবন্ধ অনুসারে, ফেসবুক থেকে শুরু করে টুইটার-স্ন্যাপচ্যাটের ৮০ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারী ইমোটিকন ব্যবহার করে।
২০১৪ সালে করা এক জরিপ জানাচ্ছে, ইমোটিকন ব্যবহারকারীদের ৫৪ শতাংশই হুটহাট আবেগ প্রকাশ করতে ইমোটিকন ব্যবহার করে। না বুঝেই তাঁরা মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলেন। গত জানুয়ারিতে সায়েন্স ডেইলি জানিয়েছে, অনলাইনে ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারী প্রতি পাঁচ ঘণ্টায় একবার কোনো না কোনো ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহার করে থাকেন।
ফেসবুকের কোনো ছবিতে বা কোনো পোস্টে কী চিহ্ন দিয়ে আবেগের প্রকাশ ঘটবে, সেটা একটু বুঝেশুনে করা দরকার। ব্র্যাকের কাউন্সেলর মনোবিদ অ্যানি বাড়ৈ জানান, ‘আমাদের দেশের তরুণেরাও ফেসবুকে ইমোটিকন আর ইমোজি বেশ দারুণভাবেই ব্যবহার করেন। হুট করেই মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ইমোটিকন ব্যবহারে সচেতন হওয়া উচিত আমাদের।’
ব্যাংকার ফাহমিদা মৌ রাঙামাটি ঘুরতে যাওয়ার ছবি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বসের কাছ থেকে একটি দুঃখবোধক ইমোটিকন পেলেন। মৌ বলেন, ‘ঘোরাঘুরির পোস্টে বসের দুঃখবোধক ইমোটিকন দেখে আমি একটু বিব্রতই। বস কি কষ্ট পাচ্ছেন, নাকি আমার আচরণে বিরক্ত, সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী স্যাফায়ার হোসেনের মামাতো বোনের ছবিতে উদ্ভট এক ইমোটিকন দিয়ে বসে তার বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পড়ুয়া মামাতো বোনের পোস্টে এমন ইমোটিকন দেখে স্যাফায়ার ভীষণ বিব্রত। তিনি বলেন, ‘বন্ধুর এমন অবিবেচক পোস্টে আমি নিজেই বিব্রত। আমার চেয়ে ছয় বছরের বড় মামাতো বোনের পোস্টে আমার বন্ধুর এমন আবেগ প্রকাশ আমার ফেসবুক জীবনকেই অতিষ্ঠ করে তুলেছে।’
অনেকেই আমরা বয়স-পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই ইমোটিকন ব্যবহার করি। ট্রেন্ডস ইন কগনিটিভ সায়েন্স সাময়িকীর গবেষণায় জানা যায়, ইমোটিকন ব্যবহার করা ৮৮ শতাংশ পোস্টেই ব্যবহারকারীরা তাঁদের অবিবেচক আচরণের ও অসচেতনতাই প্রকাশ করেন। এই তো কদিন আগে ফেসবুকে বেগুনি রঙের ঘুঘু বা কবুতরের মতো দেখতে ‘মাথা ঘুরছে’ একটি ইমোটিকন ভাইরাল হয়ে যায়। ‘ট্র্যাশ ডাভ’ নামের এই ইমোটিকন নিউইয়র্ক টাইমস–এর একটি পোস্টে একজন ব্যবহারকারী ৯২টি মন্তব্যে ৯২ বার ব্যবহার করেছেন। শুধু তা–ই নয়, অনলাইন পাঠকেরা বিজনেস ইনসাইডার, সিএনএনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক সংবাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদেও এমন ইমোটিকন অবিবেচনার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন বলে মন্তব্য করেছে দ্য ভার্জ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাত নায়লা বন্ধুর মায়ের জন্য রক্ত চাই লিখে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিল। সেখানে তারই এক বন্ধু ‘হাহা’ ইমোটিকন লেখে। আরেক শিক্ষার্থী নিশাত রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে ছবি শেয়ার করলে চাকরি করছেন সিনিয়র এক বড় ভাই রাগবোধক ইমোটিকন দেন।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অমিত বণিক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার একটি পোস্ট প্রকাশ করলে বন্ধুরা কেউ লাইক, কেউ হাহা, কেউ ভালোবাসা–বিষয়ক ইমোটিকন ও ইমোজি পোস্টে শেয়ার করে। নায়লা, নিশাত আর অমিত আসলেই বুঝে উঠতে পারেনি কেন মানুষ এভাবে ইমোটিকন ব্যবহার করেন।
মনোবিদ অ্যানির ভাষ্য, এমন আচরণে নিজের অসচেতনতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধাও প্রকাশিত হয়। এভাবে আচরণ আসলে নিজের মনের দুর্বলতাই প্রকাশ করে। আপনার ব্যবহার করা ইমোটিকন ও ইমোজি দিয়ে কিন্তু অন্যরা আপনার বুদ্ধিমত্তা আর বিবেচনার মাত্রা মেপে নেওয়ার সুযোগ পায়। সে ক্ষেত্রে নিজেকে হাস্যকর কিংবা অবিবেচক হিসেবে প্রকাশ করাটা অনুচিত। ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন।
ইমোটিকন দেওয়ার বেলায় যা খেয়াল রাখবেন
অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইমোটিকন দিন।
বেখেয়ালেও অফিশিয়াল ই–মেইলে ইমোটিকন ব্যবহার করবেন না।
বয়সে ছোট কিংবা বড় এমন কারও পোস্টে ইমোটিকন ব্যবহারের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার দিকে খেয়াল রাখুন।
সব পোস্টেই কেন ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহার করতে হবে, তা ভেবে দেখুন।
অন্য ভাষার ইমোটিকন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সচেতন থাকুন।
সব সময়ই যে পছন্দ বা অপছন্দ প্রকাশ করতে ইমোটিকন বা ইমোজি ব্যবহার করতে হবে, এমনটা ভাববেন না।